আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম স্থপতি লুইডভিগ নকশার ক্ষেত্রে অল্পকেই বেশি বলেছেন। অবশ্য `Less is more প্রবাদ বাক্যে পরিণত হওয়ার আগেই রবার্ট ব্রাউনিং তার ‘এন্ড্রু দেল সার্তো’ কবিতায় ১৮৫৫ সালেই এই বাক্য ব্যবহার করেন।
``Less is more.
Ludwig Mies van der Rohe
আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম স্থপতি লুইডভিগ নকশার ক্ষেত্রে অল্পকেই বেশি বলেছেন। অবশ্য `Less is more প্রবাদ বাক্যে পরিণত হওয়ার আগেই রবার্ট ব্রাউনিং তার ‘এন্ড্রু দেল সার্তো’ কবিতায় ১৮৫৫ সালেই এই বাক্য ব্যবহার করেন। কবিতার ক্ষেত্রে অল্পতে বেশি বলা একটা বড় গুণ। এই গুণ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করি পিয়াস মজিদের কবিতার ক্ষেত্রে। আকারে ছোট কিংবা বড় যাই হোক তার কবিতায় বাচালতা নেই। বরং অদ্রুত পরিমিতি বোধ, শব্দের মাপা ব্যবহার আর চাপা কষ্টে ভরাট থাকে পিয়াসের কবিতা।
‘স্নানের কালে দেখি
ঝরনা ঘুমিয়ে আছে।’ (নিহিত)
ব্যস, মাত্র এই দুটো লাইনেই কবিতা শেষ। এখন পাঠকের দায়ভার হয়ে পড়ে এর নিহিতার্থ খোঁজার। স্নান আর ঘুমন্ত ঝরনার আড়ালে কতো কথাই না গোপন থাকে পিয়াসের কবিতায়। আরকটি ছোট্ট কবিতার উদ্ধৃতি লোভ সামলানো যাচ্ছে না
এই নৈঃশব্দ্য
নক্ষত্রে নিনাদিত,
তোমার মুখর শ্রীভাষার
আমি সেই নির্জন পাঠক। (টেক্সট)
নৈঃশব্দ যেখানে নক্ষত্রে নিনাদিত কবি সেখানে শ্রীভাষার নির্জন পাঠক। এই সূত্রে উল্লেখ করা যাক পিয়াসের ভাষা ব্যবহারও অদ্রুত, মানে কেমন যেনো, মানে অনেকটাই মেশালো, সাধু, চলিত, ইংরেজি, বাংলার কেমন এক মিশেল, কিন্তু তাহা দোষনীয় নয়। কেননা, এ ভাষা তার কবিতার স্থাপত্যে ভিন্ন নকশা তৈরি করে। হয়তো সচেতনভাবে বৈপরীত্য, বৈচিত্র প্রয়াসে পিয়াসের কবিতায় অন্য রকম জেনেটিকস লক্ষ্য করি। যে কবিতার মধ্যে ‘নৈঃশব্দ্য’,‘নিনাদিত’, ‘শ্রীভাষা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয় সেই কবিতার শিরোনাম ‘টেক্সট’।
‘এর মাঝে আমি এক
ঋজুরেখ নক্ষত্রবাদি,
এই ক্রন্দনসিম্ফনির
কারুকাঠামো ভেদ করে
শুক-স্বাতী-অরুন্ধতীর
হৃৎমহলে যাই;’ (স্বপ্নমৃত্যুপ্রসারণ)
‘ঋজুরেখ’, ‘নক্ষত্রবাদি’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্রন্দনসিম্ফনি’ শব্দের ব্যবহার ‘কারুকাঠামো’গত দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
শব্দ ব্যবহারে পিয়াস যেমন খুবই সচেতন অথচ আলগা তেমনি দৃশ্য নির্মাণেও। তার কবিতায় এক অর্থে বিপদজনক। খুব আলগাভাবে শুরু হয়ে আকস্মিক টানটান হয়ে ওঠে তার কবিতার দৃশ্য প্রকৌশল। ‘পরিরা পিরিচে ঢেলে দিচ্ছে হিংস্র আলোর দ্যুতি।’ নাচ প্রতিমার লাশ- আট নম্বর কবিতার এই প্রথম লাইনটি কী ভয়াবহ দৃশ্যকল্পই তৈরি করে। মনে করি আমি একজন ফটোগ্রাফার অথবা চিত্রকর অথবা চলচ্চিত্র নির্মাতা তাহলে এই যে পরিরা পিরিচে আলোর এক হিংস্র দ্যুতি ঢেলে দিচ্ছে তার দৃশ্যায়নটি কীভাবে করবো! এটা সাবধান বাণীর মতোই, পিয়াসের কবিতা হুট করে নিরীহ থেকে ভয়াবহ চেহারায় রূপ নিতে পারে। উদাহরণ দেই
‘মালির অজান্তে কত নষ্ট গোলাপে ভরে ওঠে বাগান!
তার কাঁটা ও সুরভির রেখা ধরে জন্ম নেয়
আমার ঝুলন্ত চিতা।’ (ময়ূখ)
‘গোলাপের কাঁটা আমার
তোমার সব
পুষ্পিত, রক্তিম প্রকৌশল।’ (বিভা)
তিন লাইনের ‘বিভা’ কবিতা রক্ত আর কাঁটার দৃশ্যকল্পে ভরপুর, অথচ এটি একটি প্রেমের কবিতা। তবে ভয় নেই, শেষ পর্যন্ত প্রেম আর আশ্বাসেই বিশ্বাস রাখেন পিয়াস।
‘পুরুষ : আমার আঁতুড়ঘর
নিযুত সমাধির নিঃসঙ্গ শ্বাস
নারী : চল, নিষ্ফলা মাঠ
ভরে তুলি গোলায়’ (অপুষ্পক উদ্ভিদের ছায়া)
প্রেম বলি আর অন্য কোন বোধ পিয়াসের কবিতায় সবচেয়ে নজর কাড়ে তার স্থাপত্যশৈলী, কারুকাজ, শব্দ ব্যবহার। পরিমিত, মজবুত স্থাপত্যে গ্রন্থিত হয় তার কবিতা।
পাঠক, পিয়াসের কাব্য জগতে আমন্ত্রণ।
আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম স্থপতি লুইডভিগ নকশার ক্ষেত্রে অল্পকেই বেশি বলেছেন। অবশ্য `Less is more প্রবাদ বাক্যে পরিণত হওয়ার আগেই রবার্ট ব্রাউনিং তার ‘এন্ড্রু দেল সার্তো’ কবিতায় ১৮৫৫ সালেই এই বাক্য ব্যবহার করেন।
By পিয়াস মজিদ
Category: কবিতা
কবিতার স্থাপত্যকলা
``Less is more.
Ludwig Mies van der Rohe
আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম স্থপতি লুইডভিগ নকশার ক্ষেত্রে অল্পকেই বেশি বলেছেন। অবশ্য `Less is more প্রবাদ বাক্যে পরিণত হওয়ার আগেই রবার্ট ব্রাউনিং তার ‘এন্ড্রু দেল সার্তো’ কবিতায় ১৮৫৫ সালেই এই বাক্য ব্যবহার করেন। কবিতার ক্ষেত্রে অল্পতে বেশি বলা একটা বড় গুণ। এই গুণ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করি পিয়াস মজিদের কবিতার ক্ষেত্রে। আকারে ছোট কিংবা বড় যাই হোক তার কবিতায় বাচালতা নেই। বরং অদ্রুত পরিমিতি বোধ, শব্দের মাপা ব্যবহার আর চাপা কষ্টে ভরাট থাকে পিয়াসের কবিতা।
‘স্নানের কালে দেখি
ঝরনা ঘুমিয়ে আছে।’ (নিহিত)
ব্যস, মাত্র এই দুটো লাইনেই কবিতা শেষ। এখন পাঠকের দায়ভার হয়ে পড়ে এর নিহিতার্থ খোঁজার। স্নান আর ঘুমন্ত ঝরনার আড়ালে কতো কথাই না গোপন থাকে পিয়াসের কবিতায়। আরকটি ছোট্ট কবিতার উদ্ধৃতি লোভ সামলানো যাচ্ছে না
এই নৈঃশব্দ্য
নক্ষত্রে নিনাদিত,
তোমার মুখর শ্রীভাষার
আমি সেই নির্জন পাঠক। (টেক্সট)
নৈঃশব্দ যেখানে নক্ষত্রে নিনাদিত কবি সেখানে শ্রীভাষার নির্জন পাঠক। এই সূত্রে উল্লেখ করা যাক পিয়াসের ভাষা ব্যবহারও অদ্রুত, মানে কেমন যেনো, মানে অনেকটাই মেশালো, সাধু, চলিত, ইংরেজি, বাংলার কেমন এক মিশেল, কিন্তু তাহা দোষনীয় নয়। কেননা, এ ভাষা তার কবিতার স্থাপত্যে ভিন্ন নকশা তৈরি করে। হয়তো সচেতনভাবে বৈপরীত্য, বৈচিত্র প্রয়াসে পিয়াসের কবিতায় অন্য রকম জেনেটিকস লক্ষ্য করি। যে কবিতার মধ্যে ‘নৈঃশব্দ্য’,‘নিনাদিত’, ‘শ্রীভাষা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয় সেই কবিতার শিরোনাম ‘টেক্সট’।
‘এর মাঝে আমি এক
ঋজুরেখ নক্ষত্রবাদি,
এই ক্রন্দনসিম্ফনির
কারুকাঠামো ভেদ করে
শুক-স্বাতী-অরুন্ধতীর
হৃৎমহলে যাই;’ (স্বপ্নমৃত্যুপ্রসারণ)
‘ঋজুরেখ’, ‘নক্ষত্রবাদি’ শব্দের সঙ্গে ‘ক্রন্দনসিম্ফনি’ শব্দের ব্যবহার ‘কারুকাঠামো’গত দ্যোতনা সৃষ্টি করে।
শব্দ ব্যবহারে পিয়াস যেমন খুবই সচেতন অথচ আলগা তেমনি দৃশ্য নির্মাণেও। তার কবিতায় এক অর্থে বিপদজনক। খুব আলগাভাবে শুরু হয়ে আকস্মিক টানটান হয়ে ওঠে তার কবিতার দৃশ্য প্রকৌশল। ‘পরিরা পিরিচে ঢেলে দিচ্ছে হিংস্র আলোর দ্যুতি।’ নাচ প্রতিমার লাশ- আট নম্বর কবিতার এই প্রথম লাইনটি কী ভয়াবহ দৃশ্যকল্পই তৈরি করে। মনে করি আমি একজন ফটোগ্রাফার অথবা চিত্রকর অথবা চলচ্চিত্র নির্মাতা তাহলে এই যে পরিরা পিরিচে আলোর এক হিংস্র দ্যুতি ঢেলে দিচ্ছে তার দৃশ্যায়নটি কীভাবে করবো! এটা সাবধান বাণীর মতোই, পিয়াসের কবিতা হুট করে নিরীহ থেকে ভয়াবহ চেহারায় রূপ নিতে পারে। উদাহরণ দেই
‘মালির অজান্তে কত নষ্ট গোলাপে ভরে ওঠে বাগান!
তার কাঁটা ও সুরভির রেখা ধরে জন্ম নেয়
আমার ঝুলন্ত চিতা।’ (ময়ূখ)
‘গোলাপের কাঁটা আমার
তোমার সব
পুষ্পিত, রক্তিম প্রকৌশল।’ (বিভা)
তিন লাইনের ‘বিভা’ কবিতা রক্ত আর কাঁটার দৃশ্যকল্পে ভরপুর, অথচ এটি একটি প্রেমের কবিতা। তবে ভয় নেই, শেষ পর্যন্ত প্রেম আর আশ্বাসেই বিশ্বাস রাখেন পিয়াস।
‘পুরুষ : আমার আঁতুড়ঘর
নিযুত সমাধির নিঃসঙ্গ শ্বাস
নারী : চল, নিষ্ফলা মাঠ
ভরে তুলি গোলায়’ (অপুষ্পক উদ্ভিদের ছায়া)
প্রেম বলি আর অন্য কোন বোধ পিয়াসের কবিতায় সবচেয়ে নজর কাড়ে তার স্থাপত্যশৈলী, কারুকাজ, শব্দ ব্যবহার। পরিমিত, মজবুত স্থাপত্যে গ্রন্থিত হয় তার কবিতা।
পাঠক, পিয়াসের কাব্য জগতে আমন্ত্রণ।